রবি’র বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং আমাদের সম্প্রচার মাধ্যম

untitled

হারুন উর রশীদ:
মোবাইল অপারেটর রবি’র একটি ভিডিও বিজ্ঞাপন নিয়ে এখন তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। আর এই বিজ্ঞাপনটি প্রচার হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে। ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনটি পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল সমালোচনা শুরু হওয়ার পর আমি বিজ্ঞাপনটি ইউটিউবে দেখেছি।
বিজ্ঞাপনের ভাষা ও চিত্রায়ণ
এক গৃহকর্মী একটি টিশার্ট দিয়ে ঘরের জানালা মুছছেন। আর টিশার্টটির বুকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। সেই ঘরেরই ক্রিকেট ভক্ত এক তরুন( তারা ঘাড়ে ব্যথা) সেই দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললেন-
-এ বুয়া, এ, এইটা দিয়া তুমি কি করতেছ! এইটা দিয়া জানলা মুছতেছ?
-এইটাতো আমার লাক্কি(লাকি) টি শার্ট। উফ…উফ…(ঘাড়ে ব্যথা)
গৃহকর্মী- এইটাতো ছিড়া!
-আরে ধুৎ তোমার ছিড়া! আহ( ঘাড়ে ব্যথায় কুঁকরে উঠলো তরুন)
-এইটা পইরা খেলা না দেখলে বাংলাদেশ খেলা জিতবে ক্যামনে! আর এই বাসায় কারও মধ্যে কি দেশপ্রেম নাই? সব..
তরুনের সাউন্ড এবং ফুটেজ ফেড আউট। ভেসে ওঠে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বীর খোলোয়াড়দের গ্রুপ ছবি রবি’র লেগো দেয়া জর্সি গায়ে…
ব্যাকগ্রান্ড কন্ঠ…
‘আবারও মাঠে নামছে বাংলাদেশ মাঠের বাইরে রেডি হচ্ছি আমরাও। জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ অদম্য শক্তিতে।’ রবি… (বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গর্বিত স্পন্সর)

বিজ্ঞাপনের গুরুত্বপূর্ণ দিক

২১ সেকেন্ডের এই বিজ্ঞাপন চিত্রটির ভাষা এবং চিত্রে যা প্রকাশ পেয়েছে তা আমি তুলে ধরছি-
১.জাতীয় পতাকার টি শার্ট দিয়ে জানালা মোছা
২. গৃহকর্মীকে ‘বুয়া’ সম্বোধন
৩. বয়সে বড় হওয়ার পরও গৃহকর্মীকে ‘তুমি’ বলে ডাকা
৪. ভাষার অপরিশীলিত ব্যবহার
৫. অসামঞ্জস্যপূর্ণ গল্প এবং
৬. দেশপ্রেমিক তরুনকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা যে কী কারণে জাতীয় পতাকা দিয়ে জানালা মুছে তার সঙ্গে তরুনের দেশপ্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এরসঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জয় এবং রবি’র জ্বলে ওঠার কি সম্পর্ক!
বিজ্ঞাপন চিত্রে স্পষ্ট যে নারী গৃহকর্মী বয়সে তরুনের চেয়ে বড়। বিজ্ঞাপনে তরুন ওই নারীর সঙ্গে যে ভাষায় এবং যে টেম্পারে কথা বলেছেন তা একজন দেশপ্রেমিক তরুনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে ‘তুমি’ করে ডেকে রীতিমত অপমান অপদস্থ করা হয়েছে।
আর ‘বুয়া’ শব্দটি এখন আর ব্যবহার করা হয়না। এই শব্দটি পরিত্যাজ্য। এটা এখন অপমানসূচক শব্দ হিসেবে গণ্য। শব্দটি এখন গৃহকর্মী। এটা একটি পেশা। গণমাধ্যমে ‘বুয়া’ শব্দ ব্যবহার আইন এবং নৈতিকতা বিরোধী।

flag
যে সিদ্ধন্তে উপনীত হতে পারি
ক.এই বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অবমাননা করা হয়েছে।
খ.একটি পেশাকে অবমাননা করা হয়েছে।
গ. এমন এক অসহিষ্ণু তরুনের মাধ্যমে দেশপ্রেমের কথা বলিয়ে দেশপ্রেমের বিষয়টিকে হাস্যকর করা হয়েছে।
ঘ.নিজেদের ব্যবসার জন্য দেশ, জাতীয় পতাকা, দেশপ্রেম, জাতীয় ক্রিকেট দল সবকিছুকে পণ্য করা হয়েছে।
আইন ও নীতিমালা কী বলে
রবি’র এই বিজ্ঞাপন চিত্রে স্পষ্টতই বাংলাদেশের ২০১৪ সালে প্রণীত বিজ্ঞাপন নীতি মালার তিনিটি ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
৪.২.৪- বিজ্ঞাপনে গালিগালাজ পরিহার করতে হবে।( ‘বুয়া’ শব্দ ব্যবহার এবং তরুনের আচরণ।)
৪.৩.১- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলোর মর্যাদা সমূন্নত রাখতে এগুলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপণ চিত্রে ব্যবহার করা যাবেনা। ( শুধু ব্যবহারই করেনি , জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে।)
৪.৩.৩- কাউকে সামজিকভাবে হেয় এবং শ্রমের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন কোনো ধারণাকে বিজ্ঞাপনে গ্রহণ করা যাবেনা( গৃহকর্মীর সঙ্গে তরুনের আচরণ এবং ভাষার ব্যবহার।)
সম্প্রচার মাধ্যম যা করল
এই বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ- আফগানিস্তান ম্যাচের সময় এটার প্রচার ছিলো সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞাপন নীতিমালা মূলত সম্প্রচার নীতিমালা। কারণ কোনো মাধ্যমে সম্প্রচারের আগে লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা আইনে কঠিন। সম্প্রচার হওয়ার পর এর দায় দায়িত্ব যাদের বিজ্ঞাপন যাদের তাদের যতটুকু ,যারা সম্প্রচার করেছেন তাদেরও ততটুকু। কেউই দায় এড়াতে পারেন না বা অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে পারেনা।
এছাড়া এই বিজ্ঞাপন চিত্রের কলাকুশলী, পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটারসহ আরও যারা জড়িত তারও দায়ী।
আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোবাইল ফোন কোম্পানি রবি’র সমালোচনা দেখেছি কিন্তু যেসব গণমাধ্যাম এটা প্রচার করেছে তাদের ব্যাপারে কাউকে টু শব্দ করতে দেখিনি।

5d0f6598b9c23f73283652c8b2339e7e
জাতীয় সংগীতকেও ব্যবহার করেছিল তারা
মেবাইল ফোন অপরারেটর গ্রামীণফোন, বাংলা লিংক এবং রবি এর আগে তাদের ফোনের রিংটোন এবং ওয়েলকাম টিউন হিসেবে আমাদের জাতীয় সংগীতকেও বিক্রি শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের আদেশে তারা তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। গতবছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগ এক চুড়ান্ত রায়ে রিংটোন হিসেবে জাতীয় সংগীত ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওই তিন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করে। তাদের প্রত্যেককে ৩০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে যেভাবে
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪ অনুচ্ছেদ জাতীয় সংগীত পতাকা ও প্রতীক নিয়ে-
৪. (১) প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ।
(২) প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হইতেছে সবুজ ক্ষেত্রের উপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত।
(৩) প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক হইতেছে উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষ বেষ্টিত, পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত পত্র, তাহার উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া তারকা।

(৪) উপরি-উক্ত দফাসমূহ-সাপেক্ষে জাতীয় সংগীত, পতাকা ও প্রতীক সম্পর্কিত বিধানাবলী আইনের দ্বারা নির্ধারিত হইবে।
অনুচ্ছেদ ৪-এর ৪ উপ-অনুচ্ছেদে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা এবং প্রতীক সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এই যুক্তিতেই আদালত জাতীয় সঙ্গীতকে মোবাইল ফোনের রিংটোন এবং ওয়েলকাম টিউন হিসেবে হিসেবে ব্যাহার নিষিদ্ধ করেছেন। একই কারণে জাতীয় পতাকা ব্যবহারও সংবিধানের লঙ্ঘন।
তাই যারা বিজ্ঞাপনের নামে জাতীয় পতাকা শুধু ব্যবহারই করেননি, অবমাননা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা তথ্য মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্টদের দ্রুত আইনি প্রক্রিয়া শুরুর অনুরোধ করছি। শুধু প্রচার বন্ধ করে কেউ যেন রেহাই না পায়।
কলাবাগান, ঢাকা
০৯.১০.২০১৬

2 thoughts on “রবি’র বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং আমাদের সম্প্রচার মাধ্যম

Leave a comment