কারা কাউন্সিলর একরামকে ‘ইয়াবার গডফাদার’ পরিচিতি দিয়েছিল

7

২০১২ সালে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় একরামুলকে

হারুন উর রশীদ:
টেকনাফের কাউন্সিলর নিহত একরামুল হককে নিয়ে এখন সারাদেশে আলোচনা। তার স্ত্রী অভিযোগ করেছেন তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। র‌্যাব দাবী করছে একরামুল ‘মাদক ব্যবসায়ী’। সে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একরামুলের স্ত্রী যে টেলিফোন রেকর্ডটি সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাতে একরামুলের ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ হওয়ার কাহিনী প্রশ্নের মুখে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন,‘ যদি একরামুলকে হত্যা করা হয়ে থাকে তাহলে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।’
এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে একরামুল বিত্তশালী নয়। তার নিজের সাধারণ বাড়িটি’র কাজও গত ১০ বছরে শেষ করতে পারেননি। কক্সবাজার পৌর মেয়র, টেকনাফ পৌর মেয়র,স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাধারণ মানুষের যে কথা একরাম নিহত হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে তাতে কোনোভাবেই সে মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল তার প্রমাণ মেলেনি। স্থানীয় টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও একই কথা বলেছেন। তাহলে প্রশ্ন একরামকে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে পরিচিত করল কারা?
ডেটলাইন ২০১২:
২০১২ সালের অগাস্টে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের অপরাধ বিষয়ক অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠানে একরামুল হককে টেকনাফ এলাকার ‘ইয়াবা ব্যবসার গডফাদার’ হিসেবে দেখায়। সেই অনুষ্ঠানে একরামের ছবিসহ তার পরিচিতি দেয়া হয়। তাতে বলা হয় একরাম টেকনাফ যুবলীগের সভাপতি। ইয়াবা ব্যবসা করে একরামের যে সম্পদ হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: গাড়ি ২টি। টেকনাফে ২টি এবং চট্টগ্রামে ২টি বাড়ি । আর ঢাকায় আছে ফ্ল্যাট।
একরামের ছবিসহ যে গ্রাফিক্স কার্ডটিতে ওই সম্পদের হিসাব দেয়া হয় তাতে কোনো সূত্রের উল্লেখ করা হয়নি। তবে উপন্থাপক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে ওই তথ্য পাওয়ার দাবি করেন। আর দাবী করেন ১৪১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকার। প্রতিবেদনে একরামসহ ‘ইয়াবা ব্যবসার গডফাদার’ হিসেবে মোট ৬ জনের ছবি, পরিচিতি ও সম্পদের তালিকা গ্রাফিক্স কার্ডের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদনে দু’একজনের বাড়িতে গিয়ে তাদের বাড়িঘর দেখানো হলেও প্রতিবেদক একরামের বাড়িতে যাননি বা তার কোনো বক্তব্যও নেননি বা প্রচার করেননি।

1

খোলা চিঠি:
এদিকে ২৭ মে গভীর রাতে একরাম নিহত হওয়ার পর কক্সবাজার পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কাছে লেখা খোলা চিঠিতে বলেছেন, ‘প্রশাসনকে ভুল তথ্য দিয়ে আজন্ম আওয়ামী লীগ পরিবারের অহংকার টেকনাফ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও পর পর তিন তিন বার নির্বাচিত কাউন্সিল’র একরামকে হত্যা করা হয়েছে ।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুনেছি, ২০০৮ সালে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে একরামের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। সেই সময় তার বিরুদ্ধে মাদকের মামলাও হয়েছিল। যদিও মামলাটিতে একরাম নির্দোর্ষ প্রমানিত হয়। সেই সূত্রে ২০১০ সালে নাম ওঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের প্রথম তালিকাতেও। কিন্তু ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বদলির পর সেটা সংশোধন হওয়ায় নিরাপরাধ এ জনপ্রিয় কমিশনারের নাম বাদ পড়ে হাল নাগাদ সব তালিকা থেকে।’
তিনি বলেন,‘একরামের কথা ভাবলেই চোখের সামনে চলে আসে তার দুই মেয়ের ছবি। কি হবে এখন তাদের ? কি ছিল তাদের বাবার অপরাধ ? তবে কি বর্তমান প্রতিহিংসার রাজনীতি কেড়ে নিল আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারিকে। ’
কিছু প্রশ্ন:
বেসরকারি ওই টেলিভিশন চ্যানেলে একরামুল হকের ব্যাপারে সরেজমিন অনুসন্ধান না করে কিভাবে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে তার নাম প্রচার করল? তার সম্পদের যে হিসাব তারা প্রচার করেছে তা কি তদন্ত করে দেখেছে? তালিকা বা নিজস্ব সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই বাছাই না করে কি প্রচার করা যায়?
কিন্তু আমার ধারণা যাচাই বাছাই ছাড়াই প্রচার করা হয়েছে। আর যদি তাই করা হয়ে থাকে তাহলে এই সাংবাদিকতা প্রশ্নের মুখে। আমি জানি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্যকেনো সুত্র থেকে এরকম তালিকা ধরে হরহামেশাই বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তার পরিণতি যে কত মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক হতে পারে একরামুলের নিহত হওয়া তার প্রমাণ।
আরো বলে রাখি টেলিভিশনের ওই অনুষ্ঠানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকার কথা বলা হলেও সে তালিকা কিন্তু সরাসরি দেখান হয়নি। তাহলে তালিকায় একরামুলের নাম আদৌ ছিল কিনা তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমরা জানি এরকম তালিকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেমন সাংবাদিকদের খাওয়ায় আবার প্রতিপক্ষও গিলিয়ে দেয়। কিন্তু সাংবাদিক যাচাই বাছাই ছাড়া তা কেন গিলবেন? তার কী স্বার্থ? এই ফিডার বা এমবেডেড সাংবাদিকতা দেশের এবং দেশের মানুষের বড় ধরণের ক্ষতি ডেকে আনে।

hgf

দুই কন্যার সঙ্গে একরামুল

আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর করা তালিকা দিয়েতো বিচার করা যাবেনা। এই তালিকা দিয়েতো বিচারিক আদালত বিচারের রায় দেবেননা। কেউ অপরাধী কি অপরাধী না তা আদালতই নির্ধারণ করবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকা নয়। আর এমরা এও জানি তালিকা তৈরির পিছনে আছে নানা হিসাব। রাজনীতি, ঘুষ বাণিজ্য, প্রতিপক্ষকে ঘায়েলসহ নানা উদ্দেশ্য। তারপরও তালিকা ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চালাতেই পারে। কিন্তু আটকের পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ আদালতে পাঠানোই তাদের কাজ। বিচার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নয়। সেটা করলে তাকে বলা যায় অবিচার।
তাহলে সাংবাদিকদের কাজ কি? সাংবাদিকের কাজ অনুসন্ধান করে সঠিক তথ্য তুলে ধরা। কাউকে তালিকার ভিত্তিতে মাদক ব্যবসায়ী বা অপরাধী বলে চিহ্নত করে মিডিয়া ট্রায়াল করা নয়। আর তা যদি করা হয় তাহলে সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকেনা। তখন বলা যাবে কেউ করে বন্দুক দিয়ে, কেউ করে কলম বা মিডিয়া দিয়ে। যার কাজ তাকে করতে হবে। বিচারক বা পুলিশের যা কাজ, সে কাজ সাংবাদিকের নয়।
এই যে তালিকা তৈরি হয় তার পুরোপুরি স্বচ্ছতা আর নিরপেক্ষতা কি আছে? তাই কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনায় এখন যে হত্যার অভিযোগ উঠছে আমি মনে করি এর দায় এখন অনেকেরই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে দেখুন, তাহলেই কার কি দায় তা পরিস্কার হয়ে যাবে।
পূনশ্চ: ওই টেলিভিশন অনুষ্ঠানের প্রচারিত পর্বটি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। ছবিতে লোগো মুছে দিয়েছি। কারণ কাউকে হেয় করা নয়, সবাইকে সচেতন করাই আমার এই লেখার উদ্দেশ্য।
কলাবাগান, ঢাকা

Leave a comment